“মানুষ বিক্রি হতে পছন্দ করে না, কিন্তু তারা কিনতে ভালোবাসে।” – Jeffrey Gitomer
“People don’t like to be sold, but they love to buy.” – Jeffrey Gitomer
খুব সহজ বাংলায় বললে, বিষয়টা এমন দাঁড়ায়: মানুষ চায় না যে কেউ তার কাছে কিছু বিক্রি করুক, কিন্তু সে নিজে থেকেই কেনাকাটা করতে পছন্দ করে।
বিষয়টা একটু স্ববিরোধী শোনাচ্ছে, তাই না?
আসলে, গভীরভাবে ভাবলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি, আপনি, আমরা কেউই কিন্তু “এখনই কিনুন”, “৯০% ছাড়”, বা এই ধরনের মার্কেটিং পোস্টে খুব একটা উদ্দীপ্ত হই না। বরং, এই ধরনের বিজ্ঞাপন সামনে এলেই আমাদের মনে হয়, কত দ্রুত এটা স্ক্রল করে পার হওয়া যায়!
আমাদের ভেতরে এসব অফার, বা FOMO (Fear of Missing Out) টাইপের প্রোমোশন দেখলেই একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা (defense mechanism) চালু হয়ে যায়। আমাদের অবচেতন মন ভাবতে থাকে, এই ব্যক্তি বা বিজনেস পেইজটি ‘ধান্দাবাজি’ করে আমাকে একটা প্রোডাক্ট ‘গছিয়ে’ দেওয়ার চেষ্টা করছে!
মূলত “বিক্রি হওয়া” বা “Being Sold To” আমরা অপছন্দ করি ৩টি প্রধান কারণে:
১. নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় (Loss of Control): আমাদের মনে হয় কেউ আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
২. সন্দেহ (Suspicion): আমরা ভাবি, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গোপন উদ্দেশ্য আছে।
৩. চাপ (Pressure): “সীমিত সময়ের অফার” বা “স্টক শেষ”—এই কথাগুলো এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে।
অর্থাৎ, আপনি যখন বিজ্ঞাপন চালিয়ে গ্রাহককে কিছু কেনার জন্য ‘পুশ’ করবেন, আপনার টার্গেট অডিয়েন্স ধরেই নেবে যে, এই বিজ্ঞাপনটি আমার চিন্তাভাবনাকে ‘ম্যানিপুলেট’ করে সেলস আদায়ের চেষ্টা করবে। তাই সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায় না। এমনকি, আপনি যদি সরাসরি বিক্রির কথা না বলে ইমোশনাল পোস্টও দেন, অডিয়েন্সের মনে সন্দেহের বীজ বুনে দেয়… “এর আসল উদ্দেশ্য কী? একটু পরেই নিশ্চয়ই কিছু একটা ‘খাওয়াইতে চাইবে!'”
আর যদি ইমোশন বাদ দিয়ে “আজই শেষ দিন”, “আর মাত্র ১৫ জন পাবেন” টাইপের কথা ব্যবহার করেন, গ্রাহক নিজের অজান্তেই একটা মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যায়। যেই ফেসবুক বা ইউটিউবে সে এসেছিল একটু রিল্যাক্স করতে, সেখানে আপনার আমার দেওয়া এই ‘এক্সট্রা চাপ’ সে কেন নিতে যাবে?
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে… মানুষ যদি বিক্রি হতে পছন্দ না-ই করে, তাহলে কিনতে ভালোবাসে কেন?
এর ব্যাখ্যাও ৩টি পয়েন্টে দেওয়া যায়:
১. ক্ষমতায়ন ও নিয়ন্ত্রণ (Empowerment & Control): যখন আমরা নিজে থেকে কিছু কিনি।
২. সমস্যা সমাধান (Problem Solving): যখন আমরা অনুভব করি যে কেনাটা আমাদের কোনো সমস্যার সমাধান করছে।
৩. পরিচয় ও আকাঙ্ক্ষা (Identity & Aspiration): যখন পণ্যটি আমাদের পরিচয়ের বা রুচির অংশ হয়ে ওঠে।
ভেবে দেখুন, আজ পর্যন্ত আপনি বা আমি নিজের আগ্রহে যা কিছু কিনেছি, তার প্রতিটির পেছনে আমার নিজের নিয়ন্ত্রণ আর গবেষণা দুটোই ছিল। আমি হয়তো অন্য ১০টা পণ্যের সাথে তুলনা করে, রিভিউ দেখে, তারপর কিনেছি। এভাবে আমি আমার নির্দিষ্ট কোনো একটা সমস্যার সমাধান নিজ হাতে করেছি। এতে আমার অনুভব হয়, এই জিনিসটার মালিকানার পুরো অনুভূতিটা আমার।
ঠিক যেমন, নিজে খুঁজে একটা ভালো মুভি দেখলে যে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়, এটাও তেমন। একসময় সেই পণ্য বা সেবাটি আপনার পরিচয়ের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। আপনি তখন ভালোবেসেই অন্যকে সেই প্রোডাক্ট বা সার্ভিসটি সাজেস্ট করা শুরু করেন।
তো, একজন উদ্যোক্তা, মার্কেটার বা সেলস পার্সন হিসেবে আমাদের করণীয় কী?
- কম দামে বা খুব কম লাভে পণ্য বা সেবা বিক্রি করা বন্ধ করতে হবে!
চমকে গেলেন, তাই না?
কেন কম লাভে বিক্রি করবেন না, সেই আলাপে পরে আসছি। তার আগে বলি, এখন থেকে যখনই কোনো মার্কেটিং কনটেন্ট বা সেলস পিচ তৈরি করবেন, দয়া করে পণ্যের গুণাগুণ বা ফিচার বর্ণনা করা বাদ দিন বা একদম কমিয়ে ফেলুন।
আপনি কে, আপনার প্রতিষ্ঠান কী করে, আগে কতজন আপনার প্রোডাক্ট কিনেছে, কতগুলো পজিটিভ রিভিউ আছে… এই তথ্যগুলো একজন সম্ভাব্য গ্রাহকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে খুব সামান্যই ভূমিকা রাখে।
এসব তথ্য একজন গ্রাহকের সিদ্ধান্তে মাত্র ১৫% ভূমিকা রাখে।
বাকি ৮৫% জুড়ে থাকে WIIFM – What’s In It For Me?
“এতে আমার কী লাভ হবে?”
কোটি মানুষ আপনার প্রোডাক্ট কিনেছে, ভালো কথা, কিন্তু আমি কেন কিনব? আমার কী রেজাল্ট আসবে? আমার জীবনে পরিবর্তনটা কী আসবে?
অর্থাৎ, গ্রাহকের কেনাকাটার সিদ্ধান্তের ৮৫% আসে তার প্রত্যাশিত ফলাফল (anticipated outcome) বা ভবিষ্যত থেকে (অর্থাৎ, পণ্যটি ব্যবহার করার পর তার জীবনটা কেমন বদলে যাবে, সেই আশা থেকে)। আর মাত্র ১৫% আসে অতীত থেকে (অর্থাৎ, পণ্যের ফিচার, রিভিউ বা পূর্বের তথ্যের ভিত্তিতে)।
কিন্তু আমরা কি বাস্তবে সেটা করি?
আমরা একটা থ্রি-পিস ড্রেস বিক্রির জন্য একটা প্রোমোশনাল ভিডিও বানিয়েই সবার জন্য একই বিজ্ঞাপন চালাই। কিন্তু আমার এই থ্রি-পিস তো একজন গৃহিণী যেমন কিনতে পারেন, তেমনি একজন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট, একজন টিচার, বা কর্পোরেট নারীও কিনতে পারেন।
আমরা কি কখনো সব টার্গেট গ্রুপের কথা মাথায় রেখে আলাদা আলাদা কাস্টমাইজড কনটেন্ট তৈরি করে হাইপার-টার্গেটিং করি? আমরা কি প্রোডাক্টের ফিচার না বলে, ওই থ্রি-পিসটা কীভাবে একজন ভার্সিটি ছাত্রীর “প্রতিদিনের স্বস্তিদায়ক সঙ্গী” হতে পারে, বা একজন কর্পোরেট নারীর জন্য কীভাবে একটা “আত্মবিশ্বাসী লুক” দিতে পারে—সেভাবে কনটেন্ট বানাই?
জিম রোনের একটা ভিডিও দেখছিলাম। তিনি বলছিলেন, “আপনি যদি প্লেনের টিকেট বিক্রি করেন, তাহলে প্লেনের সুবিধা-অসুবিধা, আরামদায়ক সিট… বা এই জাতীয় গতানুগতিক কথা বাদ দিয়ে প্লেনটি যেখানে যাবে, সেই গন্তব্যস্থল নিয়ে কথা বলুন। প্লেন যদি ‘ক্যানারি আইল্যান্ড’ যায়, তাহলে সেই দ্বীপের অনুভূতি, স্বাদ আর অভিজ্ঞতার কথা বলুন। আপনার কথার ৯০% থাকবে গন্তব্য নিয়ে, আর বাকি ১০% হতে পারে আপনার প্লেনের অফার বা টিকেট নিয়ে।”
তাহলে এখন করণীয় কী?
২০২৬ সাল আসতে আর বেশি দেরি নেই। নিচের চেকলিস্ট ধরে আপনার বিজনেসের মাস্টারপ্ল্যান সাজিয়ে ফেলুন:
- ওয়েবসাইট: আপনার ওয়েবসাইটের কপি, পণ্যের ডেস্ক্রিপশন, এবং ছবি বা ভিডিও (ক্রিয়েটিভ) বিশ্লেষণ করে ঢেলে সাজান।
- বিজ্ঞাপন: ফেসবুক বা অন্যান্য মাধ্যমের জন্য নতুন করে সময় নিয়ে এড ক্রিয়েটিভ তৈরি করুন, যেখানে ৮৫% ফোকাস থাকবে ‘WIIFM’-এর ওপর।
- লিড জেনারেশন: লিংকডইনে অটোমেশন ব্যবহার করলে, সেই ইনভাইটেশন মেসেজ থেকে শুরু করে ফলো-আপ—সবকিছুতে ওই ৮৫% (তার কী লাভ) ফর্মুলা প্রয়োগ করুন।
- টিম ট্রেনিং: আপনার কাস্টমার কেয়ার, টেলি সেলস বা লিড জেনারেশনে যারা কাজ করছে, সবাইকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দিন।
- বিজনেস প্লে-বুক: নিজের বিজনেসের জন্য একটা মাস্টারপ্ল্যান বা ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করুন, যাতে পুরো টিম একই লক্ষ্যের দিকে এগোতে পারে।
- শেষ কথা: কাস্টমারকে ‘মাছ’ ভেবে ‘খাওয়ানোর’ চিন্তা বাদ দিন। তাদের কাছে কাস্টমাইজড ও পার্সোনালাইজড উপায়ে তাদের ‘ভবিষ্যৎ রূপান্তর’ (Future Transformation)-এর একটা পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরুন।
আর যখন আপনি এই সব কাজ ভালোভাবে করতে যাবেন, আপনি কখনোই ‘সস্তায়’ পণ্য বা সেবা বিক্রি করে সবদিকে মান নিশ্চিত করতে পারবেন না। ঠিক এই কারণেই বলেছিলাম, ‘লো’ প্রফিট মার্জিন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
অনেকে ভাবেন, কাস্টমারকে শুধু ‘ভালো’ ও ‘কোয়ালিটি’ প্রোডাক্ট দিতে পারলেই ব্যবসা সফল! কিন্তু পণ্যের মানই শেষ কথা নয়। গ্রাহককে একটা ইউনিক (সবার থেকে আলাদা) এবং মানসম্পন্ন অভিজ্ঞতা দেওয়া, তাকে কেনাকাটার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং মালিকানার অনুভূতি দেওয়া—এগুলোর জন্যও ঠিকভাবে কাজ করতে হয়।
আর এসব না করলে, আপনাকে আজীবন “৯০% ডিসকাউন্ট” আর “আজকেই শেষ অফার” – এই চক্রে আটকে থেকেই উদ্যোক্তা জীবন পার করে দিতে হবে। 😅